স্মার্টফোন কেনার আগে ক্রেতা প্রথম যে বিষয়টি নির্বাচন করে থাকেন সেটি হল কোন অপারেটিং সিস্টেমের ফোন তিনি ব্যবহার করতে চান। সেক্ষেত্রে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অথবা অ্যাপলের আইওএস এর মধ্য যেকোন একটিকে বেছে নেন ক্রেতা। আইডিসি’র জরিপ অনুযায়ী এই দুই অপারেটিং সফটওয়ার চালিত স্মার্টফোন বিক্রির হার ২০১৬ সালে ৯৯.৬ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ৯৯.৭ শতাংশ। মাইক্রোসফটকে প্রায় ছুঁড়েই ফেলে দিয়েছে গ্রাহকরা। বর্তমানে উইন্ডোজ এবং ব্ল্যাকবেরিও অ্যান্ড্রয়েড ফোন তৈরি করছে বাজার ধরার জন্য।
স্মার্টফোনের বাজার দখল করা দুই প্রতিষ্ঠানই মানের দিক থেকে অনন্য। তবে কিছু কিছু দিক থেকে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। স্মার্টফোনের কিছু পরিচিত ফিচারের বিচারে অ্যান্ড্রয়েড নাকি আইওএস এগিয়ে সেই তুলনা দেখে নেব এক নজরে।
ক্রয়ক্ষমতা
ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে অ্যান্ড্রয়েড এগিয়ে। বিশ্বের অধিকাংশ স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এই অপারেটিং সফটওয়্যারে ফোন তৈরি করে, তাই প্রতিযোগীতামূলক বাজারে কম দামে বেশি ফিচারের ফোন তৈরির প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। অন্যদিকে আইওএস চালিত একমাত্র স্মার্টফোন অ্যাপলের আইফোন। ফলে তারা দামের তুলনায় অ্যান্ড্রয়েড এর চেয়ে অনেক বেশি, ফলে তাদের ক্রেতাও সীমিত।
অ্যাপস
অ্যাপস্টোরে লক্ষ লক্ষ অ্যাপস থেকে ব্যবহারকারী তার পছন্দের অ্যাপস খুঁজে নেন। আইওএস এর তৈরিকৃত প্রায় ২.২ মিলিয়ন অ্যাপস ব্যাবহারকারীর প্রয়োজন মেটায় অন্যদিকে অ্যান্ড্রয়েড এর অ্যাপসংখ্যা ৩.৫ মিলিয়নেরও বেশি। ফলে এই দিক থেকেও এগিয়ে অ্যান্ড্রয়েড।
অ্যাপ স্টোর
গুগলের প্লে-স্টোর কিংবা অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে লক্ষ লক্ষ অ্যাপ থাকে। এই পরিমাণ অ্যাপ সন্নিবেশিত করা এবং সেগুলোর মধ্যে থেকে ভূয়া, অপ্রয়োজনীয় কিংবা ক্ষতিকর বার্তা বা স্প্যাম ছড়ানো অ্যাপ খুঁজে বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। উভয় স্টোরে এরকম অ্যাপ থাকলেও অ্যাপল স্টোরে তুলনামূলক কম অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ পাওয়া যায়। এই দিক থেকে প্লে-স্টোর এর চেয়ে অ্যাপল স্টোর বেশি সুরক্ষিত।
বিকল্প অ্যাপ স্টোর বা সাইড লোডিং
তৃতীয় পক্ষের সাইট থেকে অ্যান্ড্রয়েডে খুব সহজেই অ্যাপ লোড করা যায়। যা অ্যাপলে সম্ভব নয়। অ্যাপল তার ব্যবহারকারীদের সব রকম ম্যালওয়্যার থেকে সুরক্ষিত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অন্যদিকে ঝুঁকি থাকলেও প্লে স্টোরের বাইরের অ্যাপও সাপোর্ট করে অ্যান্ড্রয়েড।
ব্যাটারি লাইফ ও চার্জিং
স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ব্যাটারি লাইফ নিয়ে। অধিক সংখ্যক অ্যাপস ব্যাটারি লাইফ কমিয়ে দেয়। এই ক্ষেত্রে আইওএস এর চেয়ে অবশ্য এগিয়ে অ্যান্ড্রয়েড। কারণ অ্যান্ড্রয়েডে পাওয়ার সেভিং মুডসহ বেশ কিছু পাওয়ার লিমিট অপশন রয়েছে যা এর চার্জ ধরে রাখে দীর্ঘক্ষণ। অন্যদিকে আইওএস এ এ ধরণের সুবিধা থাকলেও কাস্টমাইজ করার সুবিধা কম।
চার্জিংয়ের ক্ষেত্রে আধুনিক স্মার্টফোনগুলোয় ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে তারবিহীন চার্জিং ব্যবস্থা যা অ্যাপলের আইফোন ৮, ৮+ ও আইফোন এক্স-এ পাওয়া সম্ভব।
আপডেট
অ্যাপল ব্যবহারকারীরা আইওএস-এর সর্বশেষ আপটেড খুব সহজেই তাদের ফোনে ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা এই সুযোগ নিতে চাইলে তাদের নতুন স্মার্টফোন কিনতে হবে। মিক্সপ্যানেল এর এক জরিপ থেকে দেখা যায়-
আইওএস ১১ ভার্সন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮৯.৮২ শতাংশ
আইওএস ১০ ভার্সন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭.১৮ শতাংশ
এবং এর চেয়ে পুরনো ভার্সন ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ৩ শতাংশ।
জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ আইফোন ব্যবহারকারী সর্বশেষ ভার্সনের আইওএস ব্যবহার করছেন।
অন্যদিকে অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপার ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়-
অ্যান্ড্রয়েড ৮.১ ওরিও ব্যবহারকারীর সংখ্যা ০.৮ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৮.০ ওরিও ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪.৯ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৭.১ নগাট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮.২ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৭.০ নগাট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২.৯ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৬.০ মার্শম্যালো ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৩ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৫.১ ললিপপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭.৬ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৫.০ ললিপপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪.৮ শতাংশ
অ্যান্ড্রয়েড ৪.৪ কিটক্যাট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০.৩ শতাংশ
এবং অন্যান্য পুরনো ভার্সন ব্যবহার করেন ৫ ভাগ ব্যবহারকারী।
এই দিক থেকে আইওএস ব্যবহারকারীরা অনেক বেশি আধুনিক।
কাস্টমাইজঅ্যাবিলিটি
অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীরা খুব সহজেই তাদের হ্যাডসেটের হোমস্ক্রিন, থিম, লে-আউট, উইগেট, শর্টকাট এমনকি ফোনের ইন্টারফেসও পরিবর্তন করে নিতে পারেন যা আইওএস চালিত আইফোনে সম্ভব নয়। ব্যাকগ্রাউন্ড, থিম ও উইডগেট কিছুটা পরিবর্তন করা গেলেও সেটা খুবই সীমিত। অ্যান্ড্রয়েড ফোন এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ দিয়ে ব্যবহারকারীর ইচ্ছেমত ডিফল্ট সেটিং পরিবর্তন করিয়ে নেয়ার সুবিধা দেয়।
অ্যাকসেসাবিলিটি
আইফোন ব্যবহার অ্যান্ড্রয়েডের চেয়ে সহজতর। আইওএস তাদের অপারেটিং সফটওয়্যারে ব্যবহারকারী-বান্ধব ফিচার রেখেছে যা খুব সহজেই এক্সেক করা যায়। অন্যদিকে অ্যান্ড্রয়েডের অনেক সেটিং সাধারণ ব্যবহারকারীরা বুঝতে পারেন না। এর জন্য টেকনিশিয়ানের স্মরণাপন্ন হতে হয়ে থাকে।
কল ও মেসেজিং
ফোন কল ও মেসেজিং উভয় প্ল্যাটফর্মেই চমৎকার অভিজ্ঞতা দেয় ব্যবহারকারীদের। তবে অ্যান্ড্রয়েডের কলিং অপশন কিছুটা জটিলতর এবং গুগল উদ্ভাবিত মেসেজিং অ্যাপ বেশ ঝামেলাপূর্ণ, ফলে প্রাইমারি স্টেজের ইউজাররা বেশ বিড়ম্বনায় পড়েন। এক্ষেত্রে আইওএস ব্যবহার বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের।
ইমেইল
ইমেইল আদান-প্রদানে উভয় প্ল্যাটফর্মই সহজসাধ্য হলেও আইওএস এর ক্ষেত্রে তৃতীয়পক্ষের অ্যাপ ব্যবহারের অপশন রয়েছে, যেখানে জিমেইল ব্যবহার করে খুব সহজেই ব্যবহারকারীরা ইমেইল আদান-প্রদান করতে পারে।
ম্যাপ
ম্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অ্যান্ড্রয়েড অনেক বেশি অগ্রগামী। অ্যান্ড্রয়েডের ডিফল্ট সেটিংয়ের গুগল ম্যাপ নেভিগেশনেও অ্যাপল ম্যাপের চেয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে।
ক্যামেরা
অ্যাপলের ক্যাপচারিং কোয়ালিটি, লাইটিং, কালার ও কম্পোজিশন অ্যান্ড্রয়েড চালিত ফোনের চেয়ে উন্নত। তবে সেই ধারা ভেঙ্গেছে গুগলের পিক্সেল ২ সিরিজের ফোন। পিক্সেল ২ ও পিক্সেল ২এক্সএল এর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা আইফোন ৮ ও আইফোন এক্স এর চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া অ্যান্ড্রয়েড চালিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তাদের ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনগুলোর ক্যামেরা ফিচারে আনছে রকমারি চমক।
ফটো ব্যাকআপ
ছবি সংরক্ষণের জন্য সেরা পছন্দ গুগল ফটোজ। এর ১৫ গিগাবাইটের বিশাল পরিসরে ১৬ মেগাপিক্সেলের ছবি ও ১০৮০ পিক্সেলের ভিডিও ফুটজে সংরক্ষণ করা যায়। অন্যদিকে আইক্লাউডের স্টোরেজ মাত্র ৫ গিগাবাইট।
ক্লাউড সার্ভিস
আইক্লাউডের ৫ গিগাবাইট জায়গার তুলনায় গুগল ড্রাইভের ১৫ গিগাবাইটের স্টোরেজ প্রায় তিনগুণ বড়। এই দিক থেকে স্পষ্টই এগিয়ে গুগল ড্রাইভ। তাছাড়া অ্যান্ড্রয়েডের সাথে ডিফল্ট হিসেবে গুগল ড্রাইভ থাকায় ব্যবহারকারীরা খুব সহজেই এতে স্টোর করতে পারেন। অন্যদিকে আইক্লাউডে স্টোর করার প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল। এছাড়া ব্যবহারকারী চাইলে তার গুগল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আইফোন থেকেও গুগল ড্রাইভ ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু আইক্লাউড কেবলমাত্র আইওএস ব্যবহারকারীদের জন্যই প্রযোজ্য।
ভয়েস অ্যাসিসটেন্ট
অ্যাপলের ভয়েস অ্যাসিসটেন্ট সিরি ক্যালেন্ডার সেটিং, অ্যাপয়েনমেন্ট, ওয়েব সার্চিং ও কল দেবার কমাণ্ডগুলো অনুসরণ করতে পারে অন্যদিকে গুগল অ্যাসিসটেন্ট ব্যভহারকারীদের জন্য একটি ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’। এটি ওয়েব সার্চ, ফোন সেটিং থেকে শুরু করে গেম কন্ট্রোলিংয়েও ব্যবহার করা যায়।
সিকিউরিটি
আগেই বলা হয়েছে আইফোন ব্যবহারকারীদের ম্যালওয়ার থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রয়েছে অ্যাপলের। তাছাড়া হ্যান্ডসেট এর সুরক্ষার দিক থেকেও এগিয়ে আইওএস। অ্যাপল তার গ্রাহকদের সুরক্ষা দিতে হ্যান্ডসেটে টাচ আইডি ও ফেসআইডি প্রযুক্তির উন্মেষ ঘটিয়েছে। অ্যান্ড্রয়েড চালিত ফোনের মধ্যে স্যামস্যাংসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরণের সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করলেও তাদের অপারেটিং সফটওয়্যারের কারনে তৃতীয় পক্ষের হ্যাকিং হামলা এড়ানো সহজ নয়।
কেস ও অ্যাক্সেসরিজ
এটা অনস্বীকার্য যে আইওএস চালিত আইফোন ও আইপ্যাডের জন্য যত ধরণের বৈচিত্র্যময় গ্যাজেট অ্যাপল তৈরি করেছে পুরো বিশ্বের অ্যান্ড্রয়েড চালিত ডিভাইসের তত সংখ্যাক গ্যাজেট নেই। তবে এদিক থেকে স্যামস্যাং এগিয়ে থাকলেও অ্যাপলই সেরা।
সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে যেই এগিয়ে থাকুক না কেন মূল বিচার্য বিষয় গ্রাহকের সন্তুষ্টি। ব্যবহারকারী যে ধরণের অপারেটিং সফটওয়্যারে অভ্যস্ত, তার কাছে সেটিই সেরা। সুতরাং তুলনার বিষয়টি আপেক্ষিক হলেও উভয় প্ল্যাটফর্মই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে অনন্য।
Comments
Post a Comment