সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাচ্চাদের ছবি শেয়ারিং এখন খুব বেশি স্বাভাবিক। সন্তানের সুন্দর মূহুর্তগুলোর হাস্যাজ্বল বা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি কিংবা ভিডিও শেয়ার করে শত শত লাইক কমেন্ট নিয়ে আপনিও হয়ত পরিতৃপ্ত। শুভাকাঙ্খীদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, আর নিজেকে আপডেট ভাবার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে জনপরিসরে নিজের ইমেজ বাড়াতে চান। কিন্তু স্বয়ং ফেসবুকই বলছে, থামুন। সন্তানের ছবি পোস্ট করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবুন-এর প্রভাব ঠিক কতদূর গড়াতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে…
অনলাইন পরিসরে বেশ পরিচিত একটি পরিভাষা সাইবার ক্রাইম। ফেসবুকের মত জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গুজব ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করে সহিংস পরিস্থিতি বা হয়রানি সংঘটনের বহু উদাহরণ রয়েছে। প্রাপ্ত বয়ষ্করা বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু শিশুরা? শারিরীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও মানসিক একটা প্রভাব থেকেই যায় শিশুদের ক্ষেত্রে।
বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও ভাবুন তো শিশুর বাড়ন্ত সময়ের হাজারো ছবি ফেসবুকের টাইমলাইনে পোস্ট করলেন। অসংখ্য লাইক কমেন্টের ভীড়ে আপনিও মজলেন কিন্তু শিশুটি যখন বুঝতে শিখবে- তখন তার অনেক ছবি, অনেক ঘটনা শেয়ার করার বিষয়টি তার কাছে লজ্জা ও অপমানকর মনে হতে পারে। সন্তানের এমন সমস্যায় অভিভাবক হিসেবে আপনি কতটা দায়িত্বশীল ছিলেন বলে মনে করেন?
তাছাড়া ছবি বা ভিডিও শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে আপনার সন্তানের যে ধরণের ফেসবুক ইমেজ তৈরি করেছেন, বাস্তবে তার বিপরীত হলে তার ব্যাখ্যা কী হবে আপনার কাছে?
শিশুর ছবি ব্যবহার করে অনলাইন দুনিয়ায় কোন অপ্রীতিকর বিষয় ভাইরাল হলে, অভিভাবক হিসেবে করণীয় কী?
ছবি শেয়ারিং বনাম গোপনীয়তা:
১৩ বছরের কম বয়সীদের অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ নেই ফেসবুকে। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাস হওয়া চিলড্রেনস অনলাইন প্রাইভেসি প্রটেকশন রুল(সিওপিপিএ) আইনে অনলাইনে ১৩ বছর বা এর কম বয়সী শিশুদের অবাধ গমনে বিধিনিষেধ আরোপের পাশপাশি কোন সাইটে ১৩ বছর বয়সের আগে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না।
কিন্তু জন্মের পর থেকেই যে শিশুর অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিচ্ছে তার অভিভাবক, আইন পাশ করে তার দৌরাত্ম্য কতটুকু ঠেকানো যাবে?
ফেসবুকের একটি অন্যতম ফিচার হলো ফেস রিকগজনিশন সার্ভিস। এর মাধ্যমে ছবিতে থাকা ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা হয়। ২০১৭ সালে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ছবির ১০ মিলিয়ন পরিচয় খুঁজে পাওয়া গেছে ফেস আইডি রিকগনিশন ফিচারের সাহায্যে।
এবং ২০১৫ সালে ফেসবুকের গবেষকদের একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ৫ হাজার ৭৪৯ জন তারকা ব্যক্তিত্বের ১৩ হাজার ২৩৩টি ছবির মধ্যে দশ ভাগের একভাগ ছবিতে ফেস রিকগনিশন কাজ করছে। গবেষক দলের সদস্য অ্যাডাম হার্ভে জানান, ফেসবুকের ১০ মিলিয়ন আইডি’র ছবিতে অন্তত একজন করে ১৩ বছরে কম বয়সী শিশুর ছবি রয়েছে।
তাহলে ৫০০ মিলিয়ন ছবিতে আরও কত শিশুর ছবি পাওয়া যেতে পারে? এমন প্রশ্নে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সারিতা ইয়ার্দি শোয়েনবেক জানান, ফেস রিকগনিশন বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে সঠিক হিসাব দেয় না। তবে সংখ্যাটি যে বিপজ্জক মাত্রায় রয়েছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিনি বলেন, “ফেসবুক বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে জানি না, তবে এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেই।”
আপনার প্রাণপ্রিয় শিশুটির ছবি যে অনলাইনের তৃতীয় কোন সাইট অ্যালগরিদমে ফেলে ক্লোন করেনি সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। যদি কখনও দেখেন আপনার সন্তানের ছবি বা দেহাবয়ব ব্যবহার করে আপত্তিকর বা যেকোন প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে যেটি আপনি চান না, কেমন লাগবে আপনার? এরকম যে হতে পারে সে সম্পর্কে হয়ত আপনার জানা নেই, কিংবা আপনি মানেন না। কিন্তু ইতিহাস তো বলে- এটা ভয়ঙ্কর। এমন অপ্রীতিকর ঘটনায় আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটেছে।
ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকি:
সীমিত পরিসরে শিশুর ছবি পোস্ট করে ভাবলেন চিন্তার কিছু নেই। আসলেই কি তাই? হয়ত আপনার পরিসর সীমিত, কিন্তু অনলাইনের? একটা বিষয় পরিষ্কার, সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি পোস্ট করার পর, কোন অর্থেই তার গোপনীয়তা থাকে না। হয়ত ব্যবহারকারীদের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু অনলাইনে লাখো সাইট আছে যারা ছবি ম্যানিপুলেট করে বিভিন্ন কাজে লাগায়। তাদের সবাই যে সাধু হবেন এমন ভাবা কি ঠিক?
অলাভজনক সংস্থা ‘কমনসেন্স’ মিডিয়া ও প্রযুক্তিবিশ্বে শিশু উন্নয়নে কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির পলিসি ও প্রাইভেসি বিভাগের সিনিয়র কাউন্সেলর অ্যারিয়েল ফক্স জনসন বলেন, “ফেসবুক মানুষের মৌলিক মূল্যবোধ বিকাশের অন্তরায়।
“তরুণরা ফেসবুকসহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে এক অর্থে নিজেদের বিপন্ন করে তুলছে। আপনি সেটিং পরিবর্তন করে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, মতামত কিংবা বার্তা সীমিত মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখতে পারেন। কিন্তু কোনভাবেই প্ল্যাটফর্মের কাছে বা হ্যাকার কিংবা তৃতীয় পক্ষের লোকজনের কাছে আপনার ‘গোপন’ তথ্য গোপন নয়।”
বিগত কয়েক বছরে ফেসবুক, ক্লাউড, ইমেইলসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের তথ্য, ছবি ফাঁসের মাধ্যমে মানুষের চরিত্র হরণ, তারকা ও রাজনৈতিকদের বেকায়দায় ফেলা, স্ক্যান্ডাল ঘটানো, রাজনৈতিক হানাহানি, জাতিগত দাঙ্গাসহ বিশ্বব্যাপী অসংখ্য নেতিবাচক, অনকাঙ্খিত ও অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। বহু জান ও মালের ক্ষতি হয়েছে। এর ন্যূনতম দায় বর্তায় নি সামাজিক প্ল্যাটফর্মের কাঁধে।
তবে করণীয় কী?
আপনার কাছে সন্তানের যে মূহুর্তটি মূল্যবান, সেটার মূল্য নিজেই দিন। ফেসবুকের লাইক, কমেন্টে মূল্য নিতে নয়। নিজের খেয়াল খুশির জন্য প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া স্মার্টনেসের পরিচায়ক নয়। অভিভাবকদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রীতি থেকে মুক্ত হতে চায় সন্তানরাও। তারা লাইক কমেন্ট নয়, বাবা-মা’র প্রকৃত ভালবাসা পেতে চায়।
২০১৭ সালে সন্তান জন্মের পর জুকারবার্গ নিজে মেয়ের সাথে ছবি দিয়ে ক্যাপশনে লিখেছিলেন, “দুনিয়াটা কঠিন জায়গা।” “জীবন উপভোগের জন্য বাইরে যাও আর খেলা করো।”
পরিবারের সঙ্গে বাইরে সময় কাটানো, আবেগে আত্মহারা শিশুর খেলাধুলা কিংবা উপভোগের মূহুর্তগুলো ফ্রেমবন্দী করার পর ভাবুন- শেয়ার করবেন কি?
Comments
Post a Comment