পিসি মনিটর কেনার আগে যেসব বিষয় মাথায় রাখবেন:

কম্পিউটারের সাথে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার অন্যতম ডিভাইস মনিটর। পিসি’র অন্তর্নিহিত কাজের প্রতিফলন মনিটরেই ভেসে ওঠে। তাই ভাল একটি মনিটর প্রতিটি ব্যবহারকারীর জন্য কাঙ্খিত একটি ডিভাইস। গ্রাহকের রুচি ও কাজের প্রকরণভেদে বেশ কয়েক ধরণের মনিটর তৈরি করে থাকে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে একজন ব্যবহারকারী চাইলেই তার পছন্দমত মনিটর নিতে পারেন। তবে মনিটর কেনার আগে ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করে নেয়া উচিত। এক নজরে দেখে নেয়া যাক, মনিটর কেনার আগে কি কি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:
কাজের উদ্দেশ্য:
মনিটর কেনার ক্ষেত্রে কি কাজে ব্যবহৃত হবে, সেই ভিত্তিতে মনিটর পছন্দ করা হয়ে থাকে। গেমিং পিসির জন্য ভাল রেজুলেশনের সাথে গেমাররা চান ফাস্ট রিফ্রেশ রেট ও কুইক রেসপন্স টাইম। প্রফেশনাল কাজের জন্য এক্সপার্টদের গুরুত্ব থাকে কালার অ্যাকুরেসিতে যেখানে সাধারণ ব্যবহারকারীরা চান হাই-কনট্রাস্ট ভিএ-প্যানেল।
হাই রেজুলেশন ও উন্নত মানের ছবি:
মনিটরের রেজুলেশন বলতে এর ফ্রেমে বিদ্যামান পিক্সেল সংখ্যাকে বোঝায়। 1920 x 1080 ফরম্যাটের মনিটরের অর্থ হচ্ছে এর ফ্রেমের  দৈর্ঘ্যের পিক্সেল সংখ্যা 1920 এবং প্রস্থের পিক্সেল সংখ্যা 1080p। এই সংখ্যাক পিক্সেল বিশিষ্ট ডিসপ্লে’কে বা ফুলএইচডি ডিসপ্লে বলে।  বর্তমানে  4K  এমনকি 8K মনিটরও পাওয়া যায়। 4K ডিসপ্লে’র পিক্সেল সংখ্যা 3,840×2,160  এবং 8K  এর পিক্সেল সংখ্যা 7,680×4,320।
রেসপন্স টাইম:
রেসপন্স টাইম রেট যত কম, মনিটরের দ্রুততা তত বেশি। কেবল গেমিং পিসি’র জন্য বিশেষ ধরণের এই মনিটরে প্রতি পিক্সেলে কাল ও সাদা হতে যত কম সময় লাগে তত বেশি তার রেসপন্স টাইম। দ্রুততম মনিটরের রেসপন্স টাইম ১ মিলিসেকেন্ড।
রিফ্রেশ রেট:
যে মনিটরের রিফ্রেশ রেট যত বেশি সেটি তত পরিষ্কার ছবি দেয়। হার্জ (Hz) এককে পরিমাপকৃত  গেমিং মনিটরের ক্ষেত্রে এর সংখ্যা কমপক্ষে 75Hz  হওয়া উচিত। তবে, হার্ড কোর গেমারদের ক্ষেত্রে অন্তত 144 Hz রিফ্রেশ রেট থাকা প্রয়োজন। সাধারণ ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে রিফ্রেশ রেট 60Hz এর নিচে না হওয়াই ভাল।
প্যানেল টেকনোলজি:
টিএন মনিটর দ্রুততর হলেও নিম্নমানের ছবির জন্য দামে সস্তা। আইপিএস মনিটরের রেসপন্স টাইম ও কালার ভিএ মনিটরের চেয়ে ভাল। আবার ভিএ মনিটর আইপিএস ডিসপ্লে’র চেয়ে অধিকতর ভাল কন্ট্রাস্ট দেয়।
কার্ভ কিংবা ফ্ল্যাট:
পারফরম্যান্সের বিচারে কার্ভ(বাকাঁনো) কিংবা ফ্ল্যাট(সমতল) মনিটর চান ব্যবহারকারীরা।  ভারী কাজ ও গেমিংয়ের জন্য কার্ভ মনিটর বেশি কার্যকর; সাধারণ কাজের জন্য ফ্ল্যাট মনিটরই যথেষ্ঠ।

সাধারণ কাজের মনিটর
সাধারণ কাজ অর্থাৎ কম্পিউটারের হালকা কাজ, সিনেমা বা ভিডিও দেখা, হালকা গেম খেলা, অফিসিয়াল বা ঘরের কাজের জন্য মনিটরের যেসব বিশেষত্ব বিবেচনা করা যেতে পারে-
  • কন্ট্রাস্ট ও ভিএ প্যানেল: ছবির মান বিচারের ক্ষেত্রে প্রথমে আসে কন্ট্রাস্ট, কালার স্যাচুরেশন, অ্যাকুরেসি এরপর আসে রেজুলেশন। বড় আকারের ডাইনামিক ডিসপ্লে’র ক্ষেত্রে থ্রিডি’র মানের ছবি পাওয়া যায়। ভিএ প্যানেলযুক্ত ডিসপ্লে থেকে আইপিএস বা টিএন-এর তুলনায় তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি কন্ট্রাস্ট পাওয়া যায়।
  • লো ব্লু লাইট: অনেক মনিটরই ব্লু লাইট কমিয়ে রাখার ঘোষণা দেয়। যদিও এটা খুব বেশি পার্থক্য গড়ে না। বরং নীল আলোর ঔজ্জ্বলতা কমিয়ে রাখলে বরং অন্য আলোর ওপর প্রভাব রাখে। গেমিং ও ভিডিও ক্ষেত্রে নীল আলোর প্রাবল্য কিছুটা বিঘ্ন ঘটালেও সাধারণ কাজের ক্ষেত্রে এর কোন সমস্যা নেই।
  • অ্যাসপেক্ট রেশিও: 35:1 অ্যাসপেক্ট রেশিও সাধারণ কাজের জন্য যথেষ্ঠ। তবে হাই-রেজুলেশনের ডিসপ্লে চাইলে 4K মানের 1.77:1 অ্যাসপেক্ট রেশিও’র মনিটর নিতে পারেন। যদিও দাম কিছুটা বেশি পড়বে।
  • টাচস্ক্রিন: সৌখিন উইন্ডোজ ১০ ব্যবহারকারীরা টাচস্ক্রিন মনিটর ব্যবহার করতে পারেন। যদিও খুব বেশি সুবিধা নেই, তবে ভাল লাগার জন্য অনেকেরই পছন্দ এটি। তবে ডিসপ্লে’র চেয়ে ব্যবহারকারীর দুরত্ব বেশি হলে এর কোন দরকার নেই।
দাম: বাংলাদেশের প্রযুক্তি বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মানের মনিটর রয়েছে। কনফিগারেশন ও সাইজভেদে ৫ হাজার ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ৩০ হাজার টাকা দামের মনিটর রয়েছে। টাচস্ক্রিন সুবিধা সংবলিত  Asus 19.5 Inch PT201Q FHD মনিটরের দাম ৩০ হাজার ৫০০ টাকা।

প্রফেশনালদের মনিটর

ওয়েব ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ফটোগ্রাফি, স্পেশাল ইফেক্ট আর্টিস্টিক, গেম ডিজাইনার ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে মনিটর কেনার আগে যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে-
  • কালার অ্যাকুরেসি: ভারী কাজের জন্য কালার অ্যাকুরেসি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এক্ষেত্রে মনিটরের ডিফল্ট ক্যালিবারেশন ক্যাপাবিলিটিই যথেষ্ঠ।
  • কালার গ্যামুট, কালার টেম্পারেচার ও গামা কার্ভ: প্রফেশনাল কাজের মনিটর এস-আরজিবি ও অ্যাডোব আরজিবি মানের হতে হবে। সেক্ষেত্রে কালার টেম্পারেচার সীমা 5000 থেকে 7500K হওয়া উচিত। সাধারণ ভিউয়ের ক্ষেত্রে গামা কার্ভ 1.8 থেকে 2.4 এবং ভিডিও বা সিনেমা প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে BT.1886 গামা স্ট্যান্ডার্ড থাকা প্রয়োজন।
  • আট ঘন্টার বেশি কাজের ক্ষেত্রে ফ্লিকার ফ্রি মনিটর প্রয়োজন: নতুন প্রযুক্তির মনিটর গুলোয় যেকোন ঔজ্জ্বল্যতায় এর ফ্লিকার ফ্রি বা কম্পন মুক্ত ডিসপ্লে থাকে। টানা কাজের ক্ষেত্রে এই মনিটর পছন্দের তালিকায় রাখা উচিত।
  • বিট-ডেপথ: যথাসম্ভব বেশি বিট-প্যানেল যুক্ত মনিটর কেনা উচিত। প্রফেশনাল কাজের ক্ষেত্রে অন্তত 10-bit মনিটর প্রয়োজন, 12-Bit হলেও আরও ভাল।
দাম: প্রফেশনাল কাজের মনিটরের দাম বেশ চড়া। বাজারে সাধারণ মানের প্রফেশনাল মনিটর পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার রেঞ্জে। ফুল প্রফেশনাল মনিটরের মধ্যে- Samsung 4K UHD LU28E590DS,  ASUS ProArt PA328Q 32 Inch 4K UHD, ASUS Designo Curve MX34VQ 34 Inch Ultra-wide Curved, কয়েকটি উল্লেখযোগ মডেল। এগুলোর দাম ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার এর মধ্যেই।

গেমিং মনিটর
গেমারদের জন্য বিশেষ ধরণের মনিটর তৈরি করা হয়। এর ফিচারে অন্যান্য মানের মনিটর থেকে অনেক বেশি পাথর্ক্য থাকে। গেমিং মনিটর নেবার আগে যেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে-
  • রেজুলেশন: গেমিং মনিটরের অন্যতম প্রধান শর্ত এর ডিসপ্লে রেজুলেশন। বাজারে হাই-রেজুলেশনের মনিটরের মধ্যে 1080p (Full HD), 1440p (QHD/2K) ও 2160p (UHD/4K) মানের রেজুলেশনের মনিটর পাওয়া যায়। এর মধ্যে হার্ডকোর গেমারদের জন্য কমপক্ষে 1440p (QHD/2K) রেজুলেশনের মনিটর ব্যবহার করা উচিত। এতে 30FPS সুবিধা রয়েছে। এর চেয়ে উন্নত রেজুলেশনের ক্ষেত্রে 2160p (UHD/4K) মনিটর তুলনামূলক ভাল যা থেকে 60FPS পাওয়া সম্ভব।
  • রিফ্রেশ রেট: গেমিং মনিটরের জন্য কমপক্ষে 144Hz রিফ্রেশ রেট থাকা প্রয়োজন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে রিফ্রেশ রেট এর পাশপাশি এর জিপিইউ পর্যাপ্ত কি না। 144Hz বা 240Hz রিফ্রেশ রেট এর মনিটর নেবার আগে পিসি’র গ্রাফিক্স কার্ড কতটা শক্তিশালী সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
  • অ্যাডপ্টিভ সিঙ্ক: ডিসপ্লে’তে নিরবিচ্ছিন্নতা চাইলে ফ্রি সিঙ্ক বা জি-সিঙ্ক ফিচারের মনিটরের কথা মাথায় রাখতে হবে। নতুন গেমিং মনিটরগুলোয় এই দুই ফিচার থাকে। সুতরাং কেনার আগে এটি নিশ্চিত করে নিতে হবে। এএমডি ফ্রি সিঙ্ক বিশিষ্ট মনিটর এর গ্রফিক্স কার্ডের সাথে বিনামূল্যেই এই ফিচার দিয়ে থাকে। তবে এনভিডিয়া জি-সিঙ্কের ক্ষেত্রে বাড়তি ১০০ থেকে ১৫০ ডলার বেশি খরচ পড়ে।
  • প্যানেল টেকনোলজি: আধুনিক মনিটরে দুই ধরণের প্যানেল থাকে- টিএন এবং আইপিএস। আইপিএস প্যানেল তুলনামূলক স্বচ্ছ, অ্যাকুরেট কালার ও ভিউ অ্যাঙ্গেল প্রদান করে থাকে। অন্যদিকে টিএন ফাস্ট রেসপন্স টাইম দেয়।
  • স্ক্রিন সাইজ: অন্য কাজের ক্ষেত্রে এটি তেমন কোন বিষয় না হলেও গেমিংয়ের ক্ষেত্রে মনিটরের আকার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গোমরদের জন্য ২১ থেকে ২৭ ইঞ্চি সাইজের মনিটর ভাল পারফরম্যান্স প্রদান করে।
  • কানেক্টর: আধুনিক গেমিং মনিটরের ক্ষেত্রে তিন ধরণের ইনপুট ও আউটপুট কানেক্টর থাকে। ক) ডিসপ্লে পোর্ট: অডিও-ভিডিও ট্রান্সফারের জন্য; খ) এইচডিএমআই 1.4/2.0: হাই রেজুলেশনের রিফ্রেশ রেট এর ক্ষেত্রে ডিসপ্লে পোর্ট কাজ করে না, সেক্ষেত্রে এইচডিএমআই 1.4/2. কার্যকর; গ) 5 মিমি অডিও জ্যাক: হাই পারফরম্যান্স হেডসেট বা স্পিকারের জন্য মেইনবোর্ডের ব্যাক প্যানেলের জ্যাকের বদলে মনিটরের সাথে থাকা অডিও আউটপুট চ্যানেলও ব্যবহার করা যায়।
দাম: গেমিং মনিটরগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি থাকে। মোটামুটি মানের গেমিং মনিটরের দাম শুরু হয় ১১ হাজার টাকা থেকে। বাংলাদেশের বাজারে সেরা মানের উল্লেখযোগ্য গেমিং মনিটর- Samsung C27FG73FQW VA-Panel LED Curved, Asus ROG Strix XG27VQ 27 Inch FHD Curved, LG 34UC89G-B 34 Inch Class 21:9 UltraWide Full HD ইত্যাদি ৪৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া যাবে।



Comments